।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
উজান
-পায়েল সাহু
জ্বরে মাথা তুলতে পারছেনা উজান | কালীপুজোর আর দুদিন বাকি অথচ চ্যাটার্জি পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা এখনো ওর আশাতেই বসে আছে | উজানের মতো চৌকস ছেলে আর একটাও নেই এ পাড়ায়, যেমন পড়াশোনা তেমনি খেলাধুলো তেমনি team ম্যানেজমেন্ট| সবাইকে একজোট করিয়ে কিভাবে কোনো অনুষ্ঠান সামলাতে হয় উজান বেশ ভালো জানে|
কালীপুজোটা প্রতিবছর বেশ অন্যরকম ভাবে পালিত হয় চ্যাটার্জি পাড়া নবযুবক ক্লাবে |
প্রতিমা নিজে হাতে গড়ে উজান আর প্যান্ডেল সাজানোর কাজ ক্লাবের বাকি ছেলেরা করে | কালীপুজোর পরদিন কিছু অসহায় গরীব মানুষদের নতুন বস্ত্রদান, খাওয়ানো, ওই বাচ্ছাদের নিয়ে বাজি ফাটানো… বেশ কয়েকবছর ধরে নবযুবক ক্লাব সকলের ভালোবাসার জায়গা হয়ে উঠেছে|
সন্ধ্যাবেলায় বসে ক্লাবের জলসা,সেখানেও উজানের গানেই আসর শুরু, পাড়ার কচি কাঁচা থেকে শুরু করে বয়স্করা অব্দি খুব আনন্দ সহকারে অংশগ্রহণ করেন এই অনুষ্ঠানে|
কিন্তু এবারে কি হবে ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ক্লাবের নৈঋত, বিশাখ, পলাশ, নির্বাণ, শ্রেয়ানের | মূর্তি গড়া শেষ হলেও সাজসজ্জা কিছুই করতে পারেনি এখনো| প্যান্ডেলের কাজও খাপছাড়া হয়ে আছে, আসলে উজানের শরীর খারাপে ভীষণ মনমরা ওরা সকলেই |
এবারের ঠাকুর গড়ার পর আশ্চর্য হয়ে উজান দেখেছে প্রতিমার মুখ বার বার তার স্বপ্নে আসা এক নারীর মতো | নাহ, উজান তাকে চেনে না, কোনোদিন দেখেওনি, তবু রাত হলেই সেই মুখ তাকে দেখা দেয় বারবার| অনেক প্রশ্নও করে উজান তাকে, কিন্তু কোনো জবাব সে দেয়না, শুধু স্মিত হেসে কখনো উজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কখনো বা তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে উজান |একদিন দুদিন নয়, বেশ কয়েকবছর ধরেই এমনটা হচ্ছে, কিন্তু সবকিছুই স্বপ্নে হলেও বড্ড বেশি যেন বাস্তব | ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে নিজের মায়ের জায়গায় তাকে কল্পনায় জড়িয়ে উজান শুয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ | নিজের পাগলামিতে নিজেই হেসেও ফেলে | এসব কথা কখনো কাউকে বলেনি উজান, বন্ধু বান্ধব শুনলে হয়তো হাসবে, আর সবচেয়ে কাছের মানুষ যে হতে পারতো, সেই “মা “একদম ছোট্টবেলায় উজানকে ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে |তাই কাউকেই বলা হয়নি আর|মায়ের মৃত্যুর কারণ টা চিরকালই তার কাছে এক রহস্য |বাড়িতে ওর মায়ের কোনো ছবিও বাবা রাখতে দেননি |
ছোট্ট থেকেই কালী ঠাকুরের প্রতি বিশেষ এক আকর্ষণ অনুভব করে উজান|ওর মায়ের গায়ের রংও শুনেছে খুব কালো ছিলো, তাই হয়তো মা কালির মধ্যেই নিজের মা কে খোঁজার চেষ্টা করেছে বার বার |মনের যত দাবী দাওয়া তার কাছেই বলেছে |ছোটো থেকেই বাবার সঙ্গে উজানের এক অনাকাঙ্খিত দূরত্ব |আর সেসব কারণেই খুব শ্রদ্ধাসহকারে ক্লাবের কালীপুজোর সমস্ত আয়োজন করে প্রতি বছর|
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ক্লাবের ছেলেদের কাছে খোঁজ নিয়ে গেছে রিমলি, ওরা সবাই জানে উজান আর রিমলির মধ্যে কিছু একটা চলছে কিন্তু সেটা উজান কখনো স্বীকার করেনি তবে ওরা আন্দাজ তো করতেই পারে | এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও কম করেনা ওরা|
আজ হঠাৎ রিমলি প্রস্তাব দিলো ওকে উজানের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে, সে নিজে পঞ্চানন মন্দিরে পুজো দিয়ে ফুল নিয়ে এসেছে উজানের মাথায় ছোঁয়াবে বলে |কিন্তু উজানের বাড়ি কখনো যায়নি বলে সাহসে ঠিক কুলোচ্ছে না |
নৈঋত আর শ্রেয়ান খানিক গাঁইগুই করে রিমলি কে নিয়ে চললো উজানের বাড়ির দিকে | উজান বাড়িতে একাই থাকে সারাদিন , ওর বাবা চাকরি করেন, বাড়িতে অবশ্যই কাজের লোক, রান্নার লোক আছে, এরাই মূলত দেখভাল করে উজানকে|
ওরা তিনজনে পৌঁছতে দরজা খুলে দিয়ে রান্নার মাসি উজানের ঘর দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তার কাজে |ওদের দেখে আধশোয়া হয়ে উঠে বসে উজান| চওড়া লাল পেড়ে ঘিয়ে শাড়ি,কপালে সিঁদুরের টিপ, মুখের দুপাশ থেকে উপচে পড়া অবাধ্য চুল সরাতে ব্যস্ত সুন্দরী রিমলি যেন আরো অপরূপা হয়ে উঠেছে| গায়ের রঙ কালো হলেও সুন্দরী রিমলি উজানের মুগ্ধ দৃষ্টি ছুঁয়ে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে |
রিমলি কে বাড়িতে আসতে দেখে উজান একই সঙ্গে ভীষণ অবাক ও আনন্দিত, যদিও কোনোটাই প্রকাশ না করে খুব শান্ত স্বরে সকলকে বসতে বলে|রিমলির কাছে সময় চেয়ে নিয়ে পুজো নিয়ে জরুরী কিছু আলোচনাও মুহূর্তে সেরে ফেলে বন্ধুদের সঙ্গে|
পুজো সংক্রান্ত বেশ কিছু দায়িত্ব দিয়ে দেয় বন্ধুদের |আলোচনা শেষ হতেই ব্যস্ত হয়ে নৈঋত আর শ্রেয়ান উজানের কাছে বিদায় নিয়ে ক্লাবের দিকে রওনা দেয়| পুজোর আয়োজন নিয়ে যাবতীয় বাকি কাজ যত শীঘ্র সম্ভব শেষ করে ফেলতে হবে এবং কিভাবে সেটাও উজান বুঝিয়ে দিয়েছে ওদের|
রিমলি এতক্ষন ওদের কথার মধ্যে না ঢুকে একা একাই বাড়িটা ঘুরে দেখছিলো, ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম সাজানো গোছানো |নৈঋত আর শ্রেয়ানের সঙ্গে ব্যস্ত থাকার জন্য প্রসাদী ফুলটা ছোঁয়ানোর সুযোগ পায়নি উজানের মাথায় | এখন ওদের দুজনকে বেরিয়ে যেতে দেখে তাড়াহুড়ো করে উজানের ঘরে ঢুকে প্রসাদী ফুলটা ওর মাথায় ছোঁয়াতে যেতেই পায়ে শাড়ি জড়িয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই উজান মুহূর্তের মধ্যে রিমলির কোমর টা জড়িয়ে টেনে আনে বুকের কাছে |
প্রবল এক আকর্ষণে নিমেষে এক হয়ে যায় দুজনের ঠোঁট, আদরে আদরে ভরিয়ে তুলে আবেগ আর বাঁধ মানতে চায়না দুজনের |
শরীরের সব আবরণ সরিয়ে দুজনে মিশে যায় দুজনের শরীরে |ওদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও কাছে আসা এই প্রথম| আচমকাই ঘটে যাওয়া ঘটনায় সারাজীবনের সঙ্গী হওয়ার অঙ্গীকার আরো দৃঢ় হয় দুজনের|
সেদিন রাতেই উজান বাবা কে রিমলির কথা জানায় কিন্তু তিনি রিমলির ছবি দেখে এক কথায় নাকচ করে দেন, উজানকে জানান তার একমাত্র ছেলের বৌয়ের গায়ের রঙ কালো হোক তিনি চান না |উজানের কোনো কথাই তিনি শুনতে চান না |
অদ্ভুত ভাবে সেদিন থেকে উজানের স্বপ্নে আসা সেই নারী মুখের আসাও বন্ধ হয়ে যায়|
কালীপুজোর সকালে শরীর টা বেশ ঝরঝরে লাগতেই ক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় উজান, সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজে লেগে যায় |
রিমলিকে কিন্তু এই দুদিন কেউ দেখতে পায়নি, উজানও যে খোঁজ নিয়েছে এমনটা নয়| পুজোর মণ্ডপেও না দেখে সন্ধ্যাবেলা রিমলিকে ফোন করতে ফোন টা switch off আসে |
পুজোর কাজ মিটতে মিটতে প্রায় ভোর রাত্রি, বাড়ি না ফিরে ক্লাবেই সব ছেলেরা শুয়ে পড়েছিল বিশ্রাম নিতে |
ভোররাতের ঘুমের ঘোরে উজান আবার স্বপ্ন দেখে তার এতো বছরের স্বপ্নে আসা নারীকে | আজ তিনি স্ব মহিমায় কালী মূর্তিতে, হাতে উদ্যত খাঁড়া নিয়ে, উজানকে ডেকে তিনি বলেন “যেদিন তুই নিজের পুরুষ সত্ত্বার প্রমান দিলি নারী সঙ্গমে, তার সাথে জীবন কাটাবার, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তুই স্বীকার করলি, তবে কেনো এতো উদাসীন এখনো নিজের জীবন সঙ্গিনীর প্রতি ?
তোর মায়ের জায়গায় স্থান দিয়েছিলি আমাকে, এতো বছর তোকে আগলে রেখেছি | এখন আর আমার প্রয়োজন নেই, যে তোকে সারাজীবন আগলে রাখবে সে এসেছে তোর জীবনে|কিন্তু আজ সেও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে শুধু মাত্র গায়ের রঙ কালো হওয়ার হীনমন্যতায় ঠিক যেমন তোর মা করেছিলো “|এতগুলো কথা বলে তিনি মিলিয়ে যান|
আচমকা ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে উজান | কোনো দিকে না তাকিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় লাগায় রিমলির বাড়ির দিকে |
কাকডাকা ভোরে রীতিমতো হইচই বাঁধিয়ে দেয় উজান রিমলির বাড়িতে, হতবাক রিমলির মা বাবার চোখের সামনে রিমলির ঘরের দরজা ভেঙে উজান উদ্ধার করে রিমলির খুব ধীরে ধীরে শ্বাস পড়া অচেতন দেহ |মেলে একটি খালি হওয়া ঘুমের ওষুধের শিশিও |
তড়িঘড়ি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পথেই উজান শোনে তার বাবা গতকাল সন্ধ্যায় রিমলিদের বাড়ি এসে সমস্ত পাড়া প্রতিবেশীর সামনে প্রচন্ড অপমান করে গেছেন রিমলি ও তার বাবা মা কে |গায়ের রঙ কালো মেয়েকে তিনি কখনোই বাড়ির বৌ হিসেবে মেনে নিতে পারবেন না এটাও জানিয়ে দিয়ে গেছেন |
বিকেলের দিকে রিমলি সুস্থ হতেই উজান মুখোমুখি হয় ওর বাবার|এতো বছর বাদে জানতে চায় মায়ের মৃত্যুর কারণ |সঙ্গে এও জানায় যদি সে সদুত্তর না পায় তাহলে তার মা এবং রিমলিকে আত্মহত্যার প্ররোচনার দেওয়া অপরাধে জেলের ঘানি টানাতেও পিছু হটবেনা |
ছেলের রুদ্র মূর্তির সামনে ভেঙে পড়েন বাবা| ” তোর মায়ের সঙ্গে সমন্ধ করেই বিয়েটা হয়েছিলো আমার, কিন্তু গায়ের রঙ কালো হওয়ায় কোনোদিন তাকে ভালোবাসতে পারিনি ;ঘৃণা করেছি, অনেক অত্যাচার করেছি|বিয়ের বছর ঘুরতেই তোর জন্ম | আমার মতো তোর গায়ের রঙ ফর্সা হওয়াতে তোর মায়ের ওপর আমার আক্রোশ আরো বেড়ে যায়, প্রতিদিনই তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলতাম |আর তাই একদিন রাতে সে বেরিয়ে যায় আর ফেরেনি, আমিও খোঁজ করিনি|দুদিন পর তার লাশ ভেসে উঠেছিলো রেললাইনের পাশের পুকুরে|আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস বাবা ” বলে কাঁদতে কাঁদতে উজানকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই উজান বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করা পুলিশ অফিসারকে ডেকে তার হাতে বাবাকে তুলে দেয় | “এতো বছর পরেও নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হয়েও গায়ের কালো রঙের ওপর থেকে তোমার ঘৃণা যায়নি বাবা, যদি যেতো রিমলির বাড়ি গিয়ে পাড়ার সবার সামনে অপমান করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আসতে না ;তুমি শাস্তি না পেলে যে স্বয়ং মা কালী আমাকে ক্ষমা করবে না বাবা “এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বাবাকে বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়ে উজান |কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানেনা, আজ আবারও দেখলো তার স্বপ্নে আসা সেই ভীষণ পরিচিত নারীকে |তিনি হাত নেড়ে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন আর বলছেন “তোর মধ্যে আমার সমস্ত শক্তি রইলো, পাপীকে শাস্তি দিয়ে জ্ঞানের আলোয় সমাজকে উজ্জ্বল করে তোলার দায়িত্ব রইলো তোর ওপর “| ঘুম ভাঙতেই উজান দেখলো শেষ রাতের শুকতারাটা ওর দিকেই তাকিয়ে যেন হেসে অভিনন্দন জানাচ্ছে নতুন দিনের শুরুর |
সমাপ্ত
এখনকার দিনেও এরম বহু মানুষ রয়েছে.. বড্ডো ভালো লিখেছো দি ❤
অনেক ভালোবাসা
Daru hoeche payel
Thank u
একরাশ মুগ্ধতা❤️
অনেক ধন্যবাদ